আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন আয়কর আইন ২০২৩ ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদ হতে আয়কে ন্যূনতম করের আওয়তাভুক্ত করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হল কিভাবে সঞ্চয়পত্রের সুদের উপর বাড়তি কর দিতে হবে সেটা এই ব্লগে আমরা উদাহরনসহ বিস্তারিত আলোচনা করবো।
এই পোস্টের মাধ্যমে, আপনি সঞ্চয়পত্রের সুদ হতে কর কর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা পাবেন, যা আপনার আর্থিক পরিকল্পনা করার প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে।
আয়কর আইন ২০২৩ এর ধারা ১০৫ সঞ্চয় পত্রের মুনাফা হইতে কর কর্তনের কথা বলা আছে। উক্ত ধারা অনুসারে “(১) এই আইনের অন্য কোনো বিধান বা অন্য কোনো তহবিল বা শ্রমিক স্বার্থ অংশগ্রহন তহবিলের অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত সঞ্চয়পত্রের উপর প্রাপ্ত মুনাফা কর অব্যাহতির বিষয়ে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি উক্তরূপ অর্থ প্রদানকালে ১০% (দশ শতাংশ) হারে কর কর্তন করিবেন।
(২) কোনো আয়বর্ষে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পুঞ্জিভূত বিনিয়োগ ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অতিক্রম না করলে, উক্তরূপ বিনিয়োগের অর্জিত মুনাফা হইতে এই ধারার অধীন কোনো কর কর্তন করা যাইবে না।
কিন্তু আয়কর আইন ২০২৩, ধারা ১৬৩ উপ-ধারা ২ এর দফা (খ) এর অধীন “ধারা ১০৫ সঞ্চয় পত্রের মুনাফা হইতে কর কর্তন।” ন্যূনতম কর এর অওতাভুক্ত করা হয়।
অর্থাৎ ন্যূনতম করের অওতাভুক্ত আয় ছাড়াও কোনো করদাতার যদি নিয়মিত উৎস হতে আয় থাকে তাহলে করদাতাকে বাড়তি কর প্রদান করতে হবে।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে “নিয়মিত উৎস হতে আয়” কি? আসুন আইনের ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।
“নিয়মিত উৎস” অর্থ এইরূপ কোনো উৎস যাহার ক্ষেত্রে, আয়কর আইন ২০২৩, ধারা ১৬৩ উপ-ধারা (২) এর অধীন ন্যূনতম কর প্রযোজ্য নহে;
প্রশ্ন: নিয়মিত পদ্ধতিতে কর পরিগণনা যদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হইতে কর অপেক্ষা অধিক হয়, তাহলে কি করতে হবে?
উত্তর: আয়কর আইন ২০২৩, ধারা ১৬৩ উপ-ধারা ২ এর দফা (ঘ) অনুসারে, ন্যূনতম কর প্রয়োজ্য এইরূপ কোনো উৎসের আয় নিয়মিত পদ্ধতিতে নির্ধারণ করিতে হইবে এবং উক্ত আয়ের উপর প্রযোজ্য হারে কর পরিগণনা করিতে হইবে; যদি উক্তরূপ পরিগণনাকৃত কর ন্যূনতম কর অপেক্ষা অধিক হয়, তাহা হইলে উক্ত আয়ের উপর অধিকতর কর প্রদেয় হইবে;


উদাহরণ: জনাব ফয়সাল আহমেদ ১লা জুলাই ২০২২ তারিখে মোট ৩,০০০,০০০/- টাকার ৩-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন এবং ৩০শে জুন ২০২৩ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ৩০০,০০০ টাকার উপর ৩০,০০০ টাকা উৎসে কর কর্তন করা হয়। এছাড়া ও তার বাড়ী ভাড়া বাবদ মোট ৫২০,০০০/- টাকা আয় করেন ও অন্যান্য আয় ৬২,০০০ টাকা আয় করেন । এখানে করদাতার করদায় কত?
উত্তর: এক্ষেত্রে নিয়মিত পদ্ধতিতে নিরূপিত মোট আয় (৩০০,০০০+৫২০,০০০+৬২,০০০) = ৮৮২,০০০/- টাকা
স্লাব | কর হার | কর |
প্রথম ৩৫০,০০০ টাকা | ০% | – |
পরবর্তী ১০০,০০০ টাকা | ৫% | ৫,০০০ টাকা |
পরবর্তী ৩০০,০০০ টাকা | ১০% | ৩০,০০০ টাকা |
পরবর্তী ১৩২,০০০ টাকা | ১৫% | ১৯,৮০০ টাকা |
মোট ৮৮২,০০০ টাকা | ৫৪,৮০০ টাকা |
করদাতার ধারা ১৬৩(৪) অনুসারে করদায় হবে ৫৪,৮০০ টাকা। করদাতাকে উৎস করের অতিরিক্ত আরো (৫৪,৮০০-৩০,০০০) = ২৪,৮০০ টাকা আয়কর বাবদ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া করদাতার ক্ষেত্রে সারচার্জসহ অন্যান্য অংক প্রযোজ্য হলে তা-ও পরিশোধ করতে হবে।
অথচ আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ধারা ৮২(সি) উপ-ধারা ২ এর দফা (ডি) অনুসারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হতে উৎসে কর কর্তন ছিল চূড়ান্ত করদায়। অথাৎ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হতে আর কোনো অতিরিক্ত করদায় ছিল না। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুসারে করদাতার করদায় হত নিম্নরূপ:
এক্ষেত্রে নিয়মিত পদ্ধতিতে নিরূপিত মোট আয় (৫২০,০০০+৬২,০০০) = ৫৮২,০০০/- টাকা
(নোট: করমুক্ত আয়ের সীমা ৩৫০,০০০ টাকা ধরা হল)
স্লাব | কর হার | কর |
প্রথম ৩৫০,০০০ টাকা | ০% | – |
পরবর্তী ১০০,০০০ টাকা | ৫% | ৫,০০০ টাকা |
পরবর্তী ১৩২,০০০ টাকা | ১০% | ১৩,২০০ টাকা |
মোট ৫৮২,০০০ টাকা | ১৮,২০০ টাকা |
সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হতে আয় ৩০০,০০০ টাকা ও করদায় ৩০,০০০ টাকা।
করদাতার মোট আয় (৫৮২,০০০ + ৩০০,০০০) = ৮৮২,০০০ টাকা এবং মোট করদায় (১৮,২০০ + ৩০,০০০) = ৪৮,২০০ টাকা।
করদাতার ধারা ৮২(সি) ২(ডি) অনুসারে করদায় হবে ৪৮,২০০ টাকা। করদাতাকে উৎস করের অতিরিক্ত আরো (৪৮,২০০-৩০,০০০) = ১৮,২০০ টাকা আয়কর বাবদ পরিশোধ করতে হত। এছাড়া করদাতার ক্ষেত্রে সারচার্জসহ অন্যান্য অংক প্রযোজ্য হলে তা-ও পরিশোধ করতে হবে।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর করের প্রভাব আয়কর আইন ২০২৩ বনাম আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪
বিবরন | আয়কর আইন ২০২৩ | আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ |
মোট আয় | ৮৮২,০০০ | ৮৮২,০০০ |
মুনাফা হতে কর | ৩০,০০০ | ৩০,০০০ |
মোট করদায় | ৫৪,৮০০ | ৪৮,২০০ |
নিয়মিত কর হার | ১৫% | ১০% |
এখানে নতুন আয়কর আইন ২০২৩ মোতাবেক উপরে উল্লিখিত উদাহরন অনুসারে করদাতাকে অতিরিক্ত কর ৬,৬০০ টাকা দিতে হবে।
উদাহরণ: জনাব সালাউদ্দিন কাদের সঞ্চয়পত্রে সুদ প্রাপ্ত হয়েছেন ২৪২,০০০/- টাকা, যার উপর ধারা ১০৫ অনুসারে ১০% হারে উৎসে ২৪,২০০/- কর প্রদান করেছেন। এছাড়া ও তার চাকুরী থেকে আয় মোট ১,২৫০,০০০/- টাকা আয় করেন। এখানে করদাতার করদায় কত?
উত্তর: এক্ষেত্রে নিয়মিত পদ্ধতিতে নিরূপিত মোট আয় (২৪২,০০০+১,২৫০,০০০) = ১,৪৯২,০০০/- টাকা এবং
মোট করযোগ্য আয়
= (১,২৫০,০০০-(১.২৫০,০০০/৩) + ২৪২,০০০
= (১,২৫০,০০০-৪১৬,৬৬৭) + ২৪২,০০০
= ৮৩৩,৩৩৩ + ২৪২,০০০
= ১,০৭৫,৩৩৩ টাকা
স্লাব | কর হার | কর |
প্রথম ৩৫০,০০০ টাকা | ০% | – |
পরবর্তী ১০০,০০০ টাকা | ৫% | ৫,০০০ টাকা |
পরবর্তী ৩০০,০০০ টাকা | ১০% | ৩০,০০০ টাকা |
পরবর্তী ২৭৫,৩৩৩ টাকা | ১৫% | ৪১,৩০০ টাকা |
মোট ১,০৭৫,৩৩৩ টাকা | ৭৬,৩০০ টাকা |
এক্ষেত্রে করদাতার নিয়মিত করদায় ৭৬৩,০০ টাকা।
করদাতাকে উৎস করের অতিরিক্ত আরো (৭৬,৩০০-২৪,২০০) = ৫২,১০০ টাকা আয়কর বাবদ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া করদাতার ক্ষেত্রে সারচার্জসহ অন্যান্য অংক প্রযোজ্য হলে তা-ও পরিশোধ করতে হবে।
অথচ করদাতাকে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুসারে (৪০,০০০+২৪,২০০)=৬৪,২০০ এখানে বাড়তি (৭৬,৩০০-৬৪২০০)=১২,১০০ টাকা কর পরিশোধ করতে হত না।
উপরের উদাহরন অনুসারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর করের প্রভাব আয়কর আইন ২০২৩ বনাম আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪
বিবরন | আয়কর আইন ২০২৩ | আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ |
মোট আয় | ১,৪৯২,০০০ | ১,৪৯২,০০০ |
মুনাফা হতে কর | ২৪,২০০ | ২৪,২০০ |
মোট করদায় | ৭৬,৩০০ | ৬৪,২০০ |
নিয়মিত কর হার | ১৫% | ১৫% |
সমাপনী বক্তব্যে বলা যায় করদাতার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সাথে নিয়মিত উৎস হতে আয় থাকলে করদায় বাড়বে।